বিজেপির বিরোধিতার মুখে অপরাজিতা বিল: রাজনৈতিক বিতর্ক ও আইনি জটিলতার সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ
পশ্চিমবঙ্গের 'অপরাজিতা নারী ও শিশু (ক্রিমিনাল লজ সংশোধনী) বিল ২০২৪' নিয়ে যে রাজনৈতিক ঝড় উঠেছে, তা শুধুমাত্র বাংলার রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নেই—এর প্রভাব পড়েছে জাতীয় স্তরে। আরজি কর মেডিকেল কলেজের নৃশংস ঘটনার পর সর্বসম্মতিক্রমে পটি এখন কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তির মুখে ফিরে এসেছে রাজ্য সরকারের কাছে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র সরকার এই বিলের একাধিক ধারাকে 'অতিরিক্ত কঠোর ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ' বলে অভিহিত করেছে123।

রাজনৈতিক পটভূমি ও প্রসঙ্গ
২০২ সালের আগস্ট মাসে কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজে এক তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার পর গোটা রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন যে, রাজ্যে নারী নিরাপত্তার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করা হবে। সেই অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনে 'অপরাজিতা বিল' উপস্থাপিত হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়45।
বিলটি পাশের সময় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সমর্থন জানালেও একসাথে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আপত্তি তুলে ধরেন। তার মতে, বিলটি 'তাড়াহুড়ো করে' আনা হয়েছে এবং এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে67।

বিজেপির মূল আপত্তি ও সমালোচনার বিন্দুসমূহ
১. 'ডাইভারশন ট্যাকটিক্স' অভিযোগ
বিজেপির সবচেয়ে তীব্র সমালোচনা হলো এই বিলকে 'চোখের ধাঁধানো কৌশল' হিসেবে দেখা। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, "এই বিল আসলে আর.জি কর ঘটনায় রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য একটি বিভ্রান্তিকর কৌশল। যেখানে একজন স্নাতকোত্তর চিকিৎসক প্রশিক্षণার্থী সরকারি হাসপাতালে ধর্ষিত ও খুন হলেন, সেই নিরাপত্তা ব্যর্থতাকে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা চলছে"67।
বিজেপির যুক্তি অনুযায়ী, রাজ্য সরকার প্রকৃত সমস্যার সমাধান না করে বরং একটি জনপ্রিয় বিল এনে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করছে। তাদের দাবি, যদি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকার সক্ষম হতো, তাহলে এমন ঘটনাই ঘটত না6।
২. প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতার অভাব
বিজেপি অভিযোग করেছে যে এই বিল যথাযথ সংসদীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে আনা হয়নি। শুভেন্দু অধিকারী বিধানসভায় স্পষ্ট করে বলেছেন, "আমরা এই বিলকে সমর্থন করছি, কিন্তু এত তাড়াহুড়ো কেন? আমরা চাইলে বলতে পারতাম সিলেক্ট কমিটিতে পাঠাতে। কিন্তু সেটা করা হয়নি"85।
বিজেপির মতে, এত গুরুত্বপূর্ণ একটি আইনের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ কমিটির পর্যালোচনা ও জনমত যাচাই অত্যাবশ্যক ছিল। এই প্রক্রিয়া এড়িয়ে যাওয়ায় বিলটিতে আইনি ও সাংবিধানিক ত্রুটি রয়ে গেছে বলে তারা মনে করে95।
৩. বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড ও বিচারকের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এই বিলের সবচেয়ে তীব্র সমালোচনা করেছে বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান নিয়ে। বিশেষত বিলের ৬৬ ধারায় যেখানে বলা হয়েছে যে ধর্ষণের ফলে ভিকটিম মারা গেলে বা চিরস্থায়ী উদ্ভিজ্জ অবস্থায় চলে গেলে বাধ্যতামূলকভাবে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে123।
কেন্দ্রের আপত্তি অনুযায়ী, "এই ব্যবস্থা বিচারকের স্বাধীনতা হরণ করে এবং প্রতিষ্ঠিত আইনি নীতিমালা ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধী"12। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বহুবার স্পষ্ট করেছেন যে মৃত্যুদণ্ড শুধুমাত্র 'অত্যন্ত বিরল' পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য হওয়া উচিত এবং এক্ষেত্রে বিচারকের বিবেচনার সুযোগ থাকতে হবে।

কেন্দ্রের নির্দিষ্ট আপত্তিসমূহ
ধারা ৬৪ সংশোধনী বিতর্ক
কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষভাবে আপত্তি জানিয়েছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ ধারার সংশোধন নিয়ে। বর্তমানে ধর্ষণের জন্য সর্বনিম্ন ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। অপরাজিতা বিল এটিকে 'আজীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড' করার প্রস্তাব করেছে11011।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য অনুযায়ী, "এই পরিবর্তন অতিরিক্ত কঠোর এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি শাস্তির সমানুপাতিকতার নীতি লঙ্ঘন করে"12।
ধারা ৬৫ বিলুপ্তির সমস্যা
আরেকটি বিতর্কিত বিষয় হলো বর্তমান ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৫ ধারা বিলুপ্ত করার প্রস্তাব। এই ধারায় ১৬ ও ১২ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ধর্ষণের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে1210।
কেন্দ্রের আপত্তি অনুযায়ী, "এই শ্রেণিবিভাগ তুলে দেওয়া শাস্তির সমানুপাতিকতার নীতিকে ক্ষুণ্ন করে এবং সবচেয়ে দুর্বল ভিকটিমদের আইনি সুরক্ষা কমিয়ে দিতে পারে"110।
বিজেপির রাজনৈতিক কৌশল ও দলীয় অবস্থান
সমর্থন সত্ত্বেও সমালোচনা
বিজেপির অবস্থান বেশ কৌশলগত। একদিকে তারা বিলটিকে সমর্থন জানিয়েছে কারণ এটি নারী নিরাপত্তার বিষয়, অন্যদিকে তারা তীব্র সমালোচনা করেছে এর প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে। শুভেন্দু অধিকারী বিধানসভায় স্পষ্ট করে বলেছেন, "আমরা বিলটিকে সমর্থন করছি, কিন্তু আমরা রেজাল্ট দেখতে চাই। দ্রুত বাস্তবায়ন হতে হবে"78।
সাতটি সংশোধনী প্রস্তাব
বিলটির সমর্থন জানানোর পাশাপাশি শুভেন্দু অধিকারী সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছিলেন785:
১. এফআইআর গ্রহণে অস্বীকার বা দেরি: থানা এফআইআর নিতে অস্বীকার বা দেরি করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান
২. প্রমাণ নষ্ট: তথ্যপ্রমাণ লোপাট করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি
৩. ময়নাতদন্তে বিলম্ব: ময়নাতদন্তে অযথা দেরি করলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তি
৪. বয়ান পরিবর্তন: তদন্তকারী কর্মকর্তা বা চিকিৎসক পরবর্তীতে বয়ান বদলালে শাস্তি
৫. সাক্ষ্যদানে নিরাপত্তা: সাক্ষ্যদানের সময় পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান
৬. দ্রুত বিচার: এক মাসের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করা
৭. তদন্তে স্বচ্ছতা: সমগ্র তদন্ত প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম তিনটি সংশোধনী গ্রহণের কথা বললেও বাকিগুলো প্রত্যাখ্যান করেন5।

আইনি বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি
সাংবিধানিক বৈধতা প্রশ্ন
বেশ কয়েকজন আইনি বিশেষজ্ঞ এই বিলের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আইনজীবী কৌশিক গুপ্ত বলেছেন, "বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড অসাংবিধানিক। কোনো অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড একমাত্র শাস্তি হতে পারে না"12।
নারী অধিকার কর্মীদের সমালোচনা
বাংলার একদল নারী অধিকার কর্মী ও আইনি বিশেষজ্ঞ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে একটি খোলা চিঠি লিখে এই বিলের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, "এই বিল শাস্তি বৃদ্ধি করলেও লিঙ্গ সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে এবং তাড়াহুড়ো করে উপস্থাপিত হয়েছে"12।
তৃণমূলের পাল্টা আক্রমণ ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র প্রতিক্রিয়া
বিজেপির সমালোচনার জবাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভায় তীব্র পাল্টা আক্রমণ করেন। তিনি বলেন, "এটা একটা ইতিহাস! প্রধানমন্ত্রী পারেননি। আমরা পারলাম। প্রধানমন্ত্রী দেশের লজ্জা! উনি মেয়েদের রক্ষা করতে পারেননি"13।
মমতা আরও বলেন যে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে ধর্ষণের ঘটনার কথা উল্লেখ করে, "উন্নাও, হাথরসের ঘটনায় বিচার পায়নি কেউ। যে বিধায়কের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, যে বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তাকে ফুল মালা দিয়ে সংবর্ধনা! ধর্ষণে উসকানি নয়?"13।
তৃণমূলের অভিযোগ
তৃণমূল নেতারা অভিযোগ করেছেন যে বিজেপি এই বিল বন্ধ করার চেষ্টা করছে নিজেদের কিছু নেতাকে বাঁচানোর জন্য। তৃণমূলের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ বলেছেন, "মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিলের পেছনে চালিকাশক্তি। যেখানে তিনি নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি চান, সেখানে বিজেপি প্রমাণ করেছে যে তারা এমন অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড চায় না"1415।

কেন্দ্র-রাজ্য সাংবিধানিক দ্বন্দ্ব
রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতির ভূমিকা
এই বিলটি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সি.ভি. আনন্দ বসু রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠান বিবেচনার জন্য। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তির পর রাজ্যপাল এটি রাজ্য সরকারের কাছে ফেরত পাঠান14161718।
রাজ্যপাল আনন্দ বসু বলেছেন, "এটি রাজ্যপালের সাংবিধানিক দায়িত্ব—হয় বিলে সম্মতি দেওয়া, হয় পুনর্বিবেচনার জন্য বিধানসভায় ফেরত পাঠানো, অথবা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো। এর ব্যাপক প্রভাবের কারণে আমি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছিলাম। এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কিছু প্রশ্ন তুলেছে, যার জবাব আমি রাজ্য সরকারের কাছে চেয়েছি"1819।
সাংবিধানিক সংকট
পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনা
আকর্ষণীয়ভাবে, আর.জি কর কেসের ভিকটিমের বাবা এই বিল নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, "কলকাতা পুলিশ আমার মেয়ের ক্ষেত্রে প্রমাণ নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই করেনি... এই বিলে প্রমাণ নষ্ট করার ব্যাপারে কোনো বিধান নেই। এই বিল পাশ হোক বা না হোক, আমাদের কিছু যায় আসে না"18।
তিনি আরও বলেছেন, "মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বোকা বানানোর জন্য এই বিল বিধানসভায় এনেছেন"18।

সামগ্রিক মূল্যায়ন ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
আইনি চ্যালেঞ্জ
অপরাজিতা বিল নিয়ে বিজেপির বিরোধিতা একটি জটিল বিষয়ের প্রতিফলন, যেখানে রাজনৈতিক স্বার্থ, আইনি নৈতিকতা এবং সামাজিক চাহিদা—সবকিছু একসাথে মিশে গেছে। বিজেপির আপত্তি শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিরোধিতা নয়, বরং আইনি ও সাংবিধানিক যুক্তিও রয়েছে এর পেছনে।
একদিকে রাজ্য সরকার দাবি করছে এটি নারী নিরাপত্তার জন্য প্রগতিশীল পদক্ষেপ। অন্যদিকে বিজেপি ও কেন্দ্র সরকার বলছে এটি অতিরিক্ত কঠোর এবং সাংবিধানিক নীতিমালার বিরোধী। এই দ্বন্দ্বের মাঝে আসল প্রশ্ন থেকে যায়—নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কার্যকর উপায় কী?
ভবিষ্যতে এই বিলের পরিণতি যাই হোক না কেন, এটি স্পষ্ট যে নারী নিরাপত্তার প্রশ্নে রাজনৈতিক ঐক্যমত প্রয়োজন। শুধু আইন কঠোর করলেই সমাধান হয় না—প্রয়োজন কার্যকর বাস্তবায়ন, সামাজিক সচেতনতা এবং সর্বোপরি, রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি।
এই বিতর্কের মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক বিবেচনার চেয়ে আইনি যুক্তি ও সাংবিধানিক নীতিমালাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তবেই সত্যিকারের ন্যায়বিচার ও নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
Comments
Post a Comment